বগুড়া সদর উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস | |
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। লেঃ কর্ণেল কাজী নুরুজ্জামান, ৭নং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে বগুড়া সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। গোটা দেশের ন্যায় বগুড়াতেও স্বাধীনতার দাবিতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত সংগ্রামী সর্বস্তরের জনসাধারণ ঐকবদ্ধ হন। বগুড়া সদর উপজেলায় নেতৃত্ব দেন ভাষা সৈনিক মরহুম গাজিউল হক, প্রাক্তন সংসদ সদস্য এ.কে মজিবর রহমান, ডাঃ জাহিদুর রহমান, ছাত্র নেতা মোস্তাফিজার রহমান পোটল, খোকন, সাইফুল, হিটলু, এটিএম মুসা পেস্তা, মোঃ মমতাজ উদ্দিন, শহীদ আবু সুফিয়ান, শহীদ ফজলার, এটিএম জাকারিয়া, গোলাম জাকারিয়া খান, আজিজ আহমেদ টকি, শহীদ চান্দু, আনোয়ারুল করিমসহ আরো অনেকেই। এদের মধ্যে প্রথম শহীদ হন ঠেংগামারা বাসিন্দা শহীদ তোতা মিয়া। | |
বগুড়া শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেয়ার জন্য ৪টি ক্যাম্প করা হয়। ক্যাম্পগুলো হলো-(১) বগুড়া আনসার ক্লাব মাঠ(বর্তমানে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের ভবন, রহমান নগর)। এই ক্যাম্পের চিফ ছিলেন আনোয়ারুল করিম দুলাল। এখানে ৩০/৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং দেয়া হতো। (২) ক্যাম্প সেন্ট্রাল হাইস্কুল। ক্যাম্প চিফ ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক দিপু (৩) ক্যাম্প মালতিনগর হাইস্কুল। এই ক্যাম্পের চিফ ছিলেন এটিএম মুসা পেস্তা (৪) ক্যাম্প করনেশন হাইস্কুল। এই ক্যাম্পের চিফ ছিলেন ডিংগু ।
এছাড়া বগুড়া সদর উপজেলাধিন গোকুল ইউনিয়নে রামশহর গ্রামে পীর ডাঃ মুহাম্মদ ক্বাহরুলাহ পবিবারের ১২জন সদস্যকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোষররা নির্মমভাবে হত্যা করে। প্রতি বছর রাষ্ট্রীয় ভাবে শহীদের স্বরণে দোয়া মাহফিল ও তাঁদের কবরে পুস্পস্তবক অর্পণ করা হয়।
এ দুঃসংবাদে প্রমত্ত হয়ে ওঠে বগুড়া। চারিদিকে নানা গুজব ও আশঙ্কা। সামরিক আইনের জাতাকল ভেঙ্গে ফেলার পণ। এসময় সংবাদ পাওয়া যায় যে, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তান আর্মি ট্যাংক ও সাঁজোয়া বাহিনী সহ বগুড়ার দিকে মার্চ করছে। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সদর রাস্তা ব্যারিকেডে ভরে ওঠে জনতার স্বতঃস্ফুর্ত কর্মপ্রয়াসে। যে যেভাবে পারে আর্মস সংগ্রহ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানি আর্মি বগুড়ায় প্রবেশকালে মাটিডালিতে ব্যারিকেড দেওয়া অবস্থায় এক রিক্সাচালককে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধে তিনিই প্রথম শহীদ হন। তিনিই প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। সড়কপথে কালিতলা হাটে পাকিস্তানি আর্মি শক্ত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। আধুনিকভাবে সুসজ্জিত পাকিস্তানি আর্মির সাথে কমব্যাট যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্যহন। পাকিস্তানি আর্মির গুলিতে বড়গোলায় মুক্তিযোদ্ধা আজাদ শহীদ হন। রেলগেটে মালট্রেনের বগি দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছিল। সেখানে পাকিস্তানি আর্মি বেশ শক্ত প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়।রেললাইনের আশেপাশে কতিপয় দরিদ্র দোকানদারকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানি আর্মি রেলগেট পার হতে না পেরে সেখানেই থমকে যায়। ছাত্রনেতা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যবৃন্দ এই মুক্তিযোদ্ধার রাইফেল ও বন্দুক সহ পাকিস্তানি আর্মির অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়। সকাল ৪টা থেকে প্রায় ১১টা পর্যমত্ম এই ভয়ঙ্কর লড়াই চলে। পাকিস্তান আর্মি আর কোন সুবিধা করতে না পেরে রেলগেট এর ঘুমটি ও বড়গোলা থেকে পিছু হটতে থাকে। বগুড়ার মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গনে সেদিন যে অসীম সাহস, ধৈর্য্য ও মনোবল দেখিয়েছিল ইতিহাসে তা বিরল এক দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। পাকসেনারা মহিলা কলেজে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি আর্মিরা যখন এভাবে রিট্রিট করছিল, তখন বড়গোলার মোড়ে তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংকের ছাদ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অসীম সাহসে চ্যালেঞ্জ করে। পাক আর্মি নিচ থেকে তাদের ঘিরে ফেলে। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি শেষ হয়ে গেলে পাক আর্মির হাতে তারা স্যারেন্ডার করতে বাধ্য হয়। পাকসেনারা সেখানে নির্মমভাবে মোস্তাফিজার রহমান চুন্নু ও টিটুকে বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করে। হিটলুকে তারা সঙ্গে করে নিয়ে যায়। শোনা যায় হিটলুকে তারা মেরে ফেলে তার লাশ লুকিয়ে ফেলে। বগুড়ার প্রথম পর্যায়ের এই মুক্তিযুদ্ধ ও সড়কপথে জনতার লড়াই আজো আমাদের স্মৃতি বিস্মৃতিতে এক মহান ত্যাগের মহিমা হয়ে আছে। আজো চোখ মুদলে দেখি জেগে ওঠে অজস্র দৃশ্য। যেন অন্তহীন এক চলচ্চিত্র তার সবাক দৃশ্য ছড়িয়ে দেয়। আমরা যারা কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ চোখের সামনে অবিরাম ঝলমল করে ওঠা দৃশ্যের পর দৃশ্য। এ দৃশ্য বেদনার ও বিষন্নতার। এ দৃশ্য যুগপৎ আনন্দ ও সুখের। এ দৃশ্য ত্যাগ ও অর্জনের। ত্যাগ ও অর্জন বিশাল। আমরা অর্জন করেছি একটি স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশ যার নাম। যে বাংলাদেশে আজো মুক্তিযুদ্ধের নামে শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে। যে বাংলাদেশকে ‘‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি আরো রক্ত দেবো, তবু এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’’ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুঞ্জয়ী এই ঘোষণা আজো আমাদের রক্তে প্রচন্ড আলোড়ন জাগায়। শিহরণ তোলে। আবেগ সৃষ্টি করে। যে উদ্দীপনায় আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করি। আর বাংলাদেশের রক্তাক্ত ভূমিতে সমস্ত চক্রান্ত খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস